ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অপু (Apu) ও দুর্গা (Durga) মানুষের মনে ছাপ রেখে গেছে। ‘পথের পাঁচালীতে' ((Pather Panchali ) ফুটে ওঠা দূর্গা চরিত্রটি গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো ছিল না। গ্রামের মানুষেরা তাঁকে দস্যি মেয়ে বলে ডাকতো। ভাই অপুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল অটুট। দুই ভাইবোন মিলে ফল, ফুল চুরি ছিল তাঁদের নিত্যকর্ম। দুর্গা ছিল প্রকৃতিপ্রেমী। দিদির সান্নিধ্যে এসে অপুও প্রকৃতির প্রেমে পড়েতে দেখা যায়। দিদির সান্নিধ্যে এসে ছোট্ট অপু অনেক কিছু শেখে বিশেষ করে সাঁওতাল নাচের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তারপর হঠাৎ করেই দিদির অস্বাভাবিক মৃত্যু ছোট্ট অপুকে একা করে দেয়।
বাঙালির রত্ন সত্যজিৎ রায়ের(Satyajit Ray) দক্ষ পরিচালনায় ছবির কাহিনী সিনেমার পর্দায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এজন্যই এটি একটি কালজয়ী সিনেমা। বহু বছর কেটে গেলেও বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে(Bengali Film Industry) এমন সিনেমা আর তৈরি হয়নি। তবে দীর্ঘ সময়ের পরও মানুষের মনে আজও অপু ও দুর্গা রয়ে গেছে। যে কারণে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে যে ছোট্ট অপু আর দুর্গা এখন কেমন আছেন? তারা কি করছেন এখন?
ছোট্ট অপুর চরিত্রে অভিনয় করেছিল সুবীর ব্যানার্জী (Subir Banerjee)এবং দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উমা দাশগুপ্ত (Uma Dasgupta)। ছবিটি নির্মাণের সময় টাকার অভাব ছিল। যে কারণে অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী এই ছবিতে কাজ করার জন্য নির্মাতার কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক (Remuneration) নেননি। ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল সত্তর হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মত। স্বল্প ব্যয়ের কারণে অনেক অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যে সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রীরা বিনা পারিশ্রমিক এই কাজ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করা উমা দাশগুপ্ত (Uma Dasgupta) । পথের পাঁচালী কালো জয়ী হওয়ার পিছনে এই শিল্পীর অবদান অনস্বীকার্য।
পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রযোজিত ও সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি বাংলা চলচ্চিত্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালী অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। অপু ত্রয়ী চলচ্চিত্র ধারাবাহিকের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীতে এর মুখ্য চরিত্র অপুর শৈশবকে কেন্দ্র করে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনধারা চিত্রায়িত করা হয়েছে।
এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমস্যা থাকায় নির্মাণকার্য ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে তা সম্পূর্ণ হয়। স্বল্প নির্মাণব্যয়ে অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেতার বাদক রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ ব্যবহার করে চলচ্চিত্রের সঙ্গীতাবহ সৃষ্টি করেন। এই ছবিতে সুব্রত মিত্র চিত্রগ্রহণ ও দুলাল দত্ত সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৩রা মে নিউ ইয়র্ক শহরের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের একটি প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ও পরে সেই বছরই কলকাতা শহরে মুক্তি লাভ করলে দর্শকদের প্রশংসা লাভ করে। সমালোচকরা চলচ্চিত্রটিতে প্রদর্শিত বাস্তবতাবাদ, মানবতা ও গুণমানকে প্রশংসা করলেও অনেকে এর মন্থর লয়কে চলচ্চিত্রটির খামতি বলে মনে করেন।
অপুর জীবন সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত (১৯৫৬) এবং অপুর সংসার (১৯৫৯) নামক অপু ত্রয়ী চলচ্চিত্র ধারাবাহিকের পরবর্তী দুইটি চলচ্চিত্রে দেখানো হয়। পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সামাজিক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে সমান্তরাল চলচ্চিত্রের ধারা তৈরি করে। স্বাধীন ভারতে নির্মিত পথের পাঁচালী ছিল প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়। এটি ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার লাভ করে, যার ফলে সত্যজিৎ রায়কে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন বলে গণ্য করা হয়। এছাড়াও এই চলচ্চিত্রটিকে প্রায়ই সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় দেখা যায়।
No comments:
Post a Comment